বাংলা গানের কাঠামো বলতে এখন যাকে আমরা চিরন্তন বলে মনে করি তারই উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। বর্তমান সময়ে আধুনিক বাংলা গান যে দুটি কাঠামো মেনে রচিত হচ্ছে, তেমনই দুটি গান উদ্ধৃত করলাম।


গান ।। ১ ।।


আস্থায়ী :          ওই পারে খেয়া এই পারে দেয়া
                    মাঝ নদী জুড়ে পাগলা বাতাস ভিজছে
                    এযেন আমার মন হারাবার
                    খেয়ালী খেলার ইচ্ছে ।।


অন্তরা :   দেখে-   খ্যাপা-শ্রাবণের এই পাগলামি
                     এই আমি তবু নেই যেন আমি
                     বুঝি না কে কারে এপারে ওপারে
                     কোথায় ভুলিয়ে নিচ্ছে ।।


সঞ্চারী :            চেনার ভিতরে বাইরে
                     জানি না কোথায় যাইরে
             শুধু-   বাদল ধারার বিরাম নাইরে নাইরে ।


আভোগ : আমি-   ভাবি না তো আর কার সংগীতে
                     কোন খেয়া আসে ওই পারে নিতে
                     ভাসাতে যে পারে এপারে ওপারে
                     সে আজ মিলিয়ে দিচ্ছে ।।


- সুর : সুজেয় শ্যাম; শিল্পী : সৈয়দ আব্দুল হাদি ।


গান ।। ২ ।।


আস্থায়ী :           জলে ভাসা কলমিলতা
                     সেও কি বোঝে জলের কথা
                     হাজার বছর সঙ্গে থেকেও
                     সঙ্গী হওয়া যায় না ।
                     মাঝে মাঝে চোখ দুটিও
                     হয় না মনের আয়না ।।


প্রথম অন্তরা :      সুদিন বলো ক'দিন থাকে
                     দু'দিন ছাড়া নয় তো,
                     সেই দু'টি দিন সঙ্গে রবে হয়তো !
                     যে জন হবে চিরদিনের
                     মনতো তাকে পায় না ।।


দ্বিতীয় অন্তরা :     দু'জন মিলে ক'জন বলো
                     সুজন হয়ে থাকলো
                     সত্যি করে কেইবা কাকে ডাকলো?
                     নিজের কথা ছাড়া তো কেউ
                     ভাবতে কিছু চায় না ।।


- সুর : খোন্দকার নূরুল আলম; শিল্পী : আঞ্জুমান আরা বেগম


এই গান দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছন্দ এবং ভিন্ন ভাবের গান। ছন্দ এবং ভাব নিয়ে পরে আলোচনা করবো আমরা। এখন কথা বলবো দু'টি গানের কাঠামো নিয়ে। গানের যে আদর্শ কাঠামো তা চারটি স্তরে বিভাজিত। (১) আস্থায়ী (২) অন্তরা (৩) সঞ্চারী (৪) আভোগ। প্রথম গানটিতে এই চারটি স্তরই আছে। 'ওই পারে খেয়া'... থেকে শুরু করে 'খেয়ালী খেলার ইচ্ছে।।' পর্যন্ত অংশ আস্থায়ী। এরপর, 'দেখে- খ্যাপা-শ্রাবণের'... থেকে শুরু করে 'কোথায় ভুলিয়ে নিচ্ছে।।' পর্যন্ত অংশ অন্তরা। অন্তরাতে আবার দুটি অংশ আছে। এখানে অন্তরার শেষ দুটি পঙক্তি হচ্ছে, অন্তরা শেষের সেতুবন্ধ পঙক্তি। কারণ এই অংশটুকুর শেষে 'নিচ্ছে' শব্দটা দিয়ে আস্থায়ীর শেষের 'ইচ্ছে' শব্দটার সঙ্গে মিল ঘটিয়ে আস্থায়ীতে ফেরার জন্যে সেতু রচনা করা হয়েছে। অন্তরার পরের অংশটি হচ্ছে সঞ্চারী। 'চেনার ভেতরে বাইরে'... থেকে 'বিরাম নাইরে নাইরে।'- পর্যন্ত পঙক্তি তিনটি এগানের সঞ্চারী। 'আমি ভাবি না তো আর'... থেকে শুরু করে 'সে আজ মিলিয়ে দিচ্ছে।।' পর্যন্ত অংশ আভোগ। যে কোন মনোযোগী পাঠকই লক্ষ্য করতে পারবেন যে, আভোগেও অন্তরার মত সেতুবন্ধ পঙক্তি আছে। 'দিচ্ছে' শব্দটি আস্থায়ীর শেষের 'ইচ্ছে'র সঙ্গে মিল ঘটিয়ে আস্থায়ীতে ফিরবার সেতু গড়ে দিয়েছে।


এই যে চারটি স্তরে বিভাজন তা এই উপমহাদেশের রাগসংগীতেও ছিলো। এই কারণে এই স্তর সমূহের নামকরণ এবং উচ্চারণ পদ্ধতি একই রাখা হয়েছে। শব্দগুলি সবই সংস্কৃত শব্দ। রাগসংগীতের বিকাশ বাংলার অনেক আগেই হিন্দী অধ্যুষিত অংশে ঘটায়, সংস্কৃত থেকে ব্রজবুলি ও ঠেটহিন্দীর ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়েছে। যাইহোক, 'আস্থায়ী' গানের একদম শুরুর অংশ হওয়ায় গানের কবিতার বক্তব্যটি কী, তার পূর্ণ আভাস এই অংশে ফুটে উঠতে হবে। অন্তরাতে ভাবনাটিকে ক্রমপ্রকাশের পথে নিয়ে যেতে হবে।  আবার আস্থায়ীতে যদি একটি ভাবনার একাংশ পূর্ণভাবে এসে যায়, তবে অন্তরাতে ভাবনার পরবর্তী অংশের উন্মোচন ঘটাতে হবে। আর যদি সম্পূর্ণ ভাবনাটাই আস্থায়ীতে চলে আসে- তবে অন্তরার কাজ হবে নানা উপমা রূপকের সাহায্যে তার ব্যাখ্যা দেয়া বা তাকে আরো ব্যঞ্জনাময় করে তোলা। সঞ্চারীর কিন্তু আস্থায়ীর ভাব বহন, ব্যাখ্যা, ইত্যাদি কোন দায় নেই। দায় না থাকলেও দায়িত্ব কিন্তু কিছুটা আছেই। বাইরে থেকে আসা কোন অতিথি যেমন সে বাড়ীর কোন সংকট দেখলে একেবারে হাতগুটিয়ে বসে থাকতে পারে না- তার থেকেও এ দায়িত্বটা একটু বেশী। একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ এনে মূল প্রসঙ্গকে আরো ব্যঞ্জনাময় করে তোলাই সঞ্চারীর কাজ। অনেক গানে এমন দেখা গেছে যে, আস্থায়ী ও অন্তরাটা শুনে মনে হচ্ছে এটা নিছক প্রেম অথবা নিছক প্রকৃতি বিষয়ক গান। কিন্তু সঞ্চারী যুক্ত হতেই দেখা গেলো, তার ভাব বদলে- হয়তো আধ্যাত্মিক চেতনায় পৌঁছে গেছে। এছাড়াও সঞ্চারীর আর একটি কাজ, সুরের ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনা। কারণ প্রায় ক্ষেত্রেই অন্তরা ও আভোগ একই পরিমাপে রচিত হয় এবং একই সুরে গাওয়া হয়। সঞ্চারীর পরিমাপ যেহেতু অন্তরা থেকে ভিন্ন, তাই তাতে সুরের ভিন্নতা আসাটাই স্বাভাবিক। আস্থায়ী, অন্তরা ও সঞ্চারী মিলে যে আবহ সৃষ্টি হলো, তাকে পূর্ণতা দেয়াই আভোগের কাজ। একটা কথা ভুললে চলবে না যে কোনো কোনো গানে গল্পের আভাস থাকলেও গানের কবিতার কাজ গল্প বলা নয়। কবিতা হয়ে ওঠাতেই তার গৌরব। আভোগ গানের ভাব ও ভাবনাকে পূর্ণতা দিলেও 'গল্পটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো'র মত ভাবনাতে যবনিকা টেনে দেবে না। যা ভাবনাকে শ্রোতার মনে অনুরণিত করতে ব্যর্থ হয় তা সার্থক গানের কবিতা হয়ে ওঠে না। শুধু সুরে নয়, গানের কবিতাতেও শেষের পরে যেন রেশ রয়ে যায়। উদ্ধৃত প্রথম গানটি লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, অন্তরা এবং আভোগের শেষে যেমন সেতুবন্ধ পঙক্তি আছে, সঞ্চারীর শেষে তেমনটি নেই। এ থেকেও সঞ্চারীর বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে দ্বিতীয় গানটি পড়লেই আমরা বুঝতে পারবো- এখানে আদর্শ কাঠামোটি নেই। গানটিতে চারটি স্তর নেই। তিনটি স্তরেই গানটি শেষ হয়ে গেছে। বাদ পড়ে গেছে সঞ্চারী। অর্থাৎ আস্থায়ীর মূলভাবটির সঙ্গে মিলিয়ে কোন ভিন্ন ভাব এখানে সঞ্চারীতে হয়নি। তাই আভোগের যে মূলকাজ, উভয় ভাবের বিস্তারকে সমন্বিত করে সম্পূর্ণতা দান, তা এখানে নেই - সেই কারণেই এখানে গানের শেষ স্তরকে আর আভোগ বলা হয় না। বলা হয় দ্বিতীয় অন্তরা।


'সঞ্চারী' প্রায় বিলুপ্তির পথে যাবার প্রথম কারণ রচয়িতার অক্ষমতা। শর্ত মেনে, সঞ্চারীর পঙক্তিগুলোকে, বিশেষ অর্থবহ করে, গানের কবিতাকে ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করার জন্যে যে কবিতাপ্রতিভার প্রয়োজন, নজরুলের পর ক্রমে ক্রমে তার আকাল ঘটতে থাকে। ক্রমে ক্রমে সংগীতজ্ঞ কবির সংখ্যাও হ্রাস পায়। তাই সংগীতের সৌকর্যের বিষয়টি নিয়ে চিন্তার অভাব দেখা দেয় গানের কবিতা রচনায়। এ ব্যাপারে যাঁদের উৎকণ্ঠিত হবার কথা সেই সুরস্রষ্টাবৃন্দও কেন জানি না আপোষ করতে শুরু করেন। যাই হোক, পরের পর্বে গানের কবিতার আদর্শ কাঠামো নিয়ে আলোচনা করা হবে।


---------


লেখাটির পরবর্তী অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন: গানের কাঠামো - ২