আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রভাতসঙ্গীত। আগেই বলেছি প্রভাতসঙ্গীতের মোট সংখ্যা ৫০১৮। সঙ্গীতগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শুধু কলেবরেই নয় ভাবসমারোহের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যেও সঙ্গীতগুলি অনন্য।
সঙ্গীতের মূল উপাদান চারটি--ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দ। প্রথমে প্রভাতসঙ্গীতের ভাবভূমিতেই দৃষ্টি রাখা যাক। এক কথায় বলতে গেলে প্রভাতসঙ্গীতের প্রতিটি গানেই আঁকা রয়েছে এক সূক্ষ্ম মননবোধের বর্ণালী আল্পনা। গীতিকার এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যেন প্রতিটি গান লিখেছেন। প্রভাতসঙ্গীতের প্রথম গানটি মাত্র চার লাইনের। এই চার লাইনের মধ্যেও এক বিরাট বার্তা রয়েছে--এক বিশেষ আবেদন রয়েছে। গানটা এই রকম--


বন্ধু হে নিয়ে চল
আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে।
আঁধারের ব্যথা আর সয়না প্রাণে।
ঘুমের ঘোর ভাঙানোর গানে গানে। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--১)


বন্ধু এখানে পরমেশ্বর। জগদ্বন্ধুকে আবেদন জানিয়ে তিনি বলছেন, হে বন্ধু তুমি আমাদের আলোর পথে নিয়ে চল। অন্ধকারের ব্যথা আজ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তুমি আমাদের গানে গানে ঘুম ভাঙিয়ে দাও। আমাদের জাগিয়ে দাও।


মানুষ আলো চায়। রাত্রির কালো কুহেলিকা ভেদ করে আলো বয়ে আনে সোণালী প্রভাত। প্রভাতের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাছে গাছে পাখি ডাকে, ফুলকলি পাপড়ী মেলে। সাধকরা ধ্যানমগ্ন হ’ন, মানুষ নোতুন উদ্যমে কর্মতৎপর হয়ে উঠে। প্রভাত মানে তাই বৈচিত্র্যের আনন্দমেলা, কর্মোৎসবের উচ্ছ্বাস, আলোর ঔজ্জ্বল্য। নিশাবসানে প্রভাতকে স্বাগত জানাতে তাই সবাই উণ্মুখ থাকে। কিন্তু প্রভাতসঙ্গীতের কথা হলো,


ঘরের আঁধার প্রদীপ জ্বেলে দূর করিতে পারি
আমি দূর করিতে পারি
মনের আঁধার দূর করিতে কিছুতে যে নারি। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--১০৯৭)


সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে যে কালো ছায়া পৃথিবীকে গ্রাস করে তা তো কেবল জাগতিক ক্ষেত্রে। প্রদীপ জ্বালালেই সে অন্ধকার দূরে সরে যায়। সূর্য উঠলেই সে আঁধার ডুবে যায়। কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে সঞ্চিত যে তমসারাশি তা তো প্রকাশ্য দিবালোকেও বর্তমান থাকে। সেই অন্ধকার যে এত সহজে দূর করা যায় না। মনের অন্ধকার কী করে দূর করা যায়? সেই অন্ধকার দূর করতে হলে মনকে কল্মষমুক্ত করা দরকার, মানস আকাশে বিবেকসূর্য উদিত হওয়া  দরকার। মনকে দিব্য আলোয় আলোকিত করা দরকার। সাংস্কৃতিক জগৎ  নন্দন-সূর্যের আলোকপুঞ্জে রঞ্জিত হওয়া দরকার।


ব্যষ্টি তথা সমষ্টি সর্ব ক্ষেত্রে আজ অমানিশার ঘন অন্ধকার। মানব-সংস্কৃতি আজ  কুহেলিকাচ্ছন্ন। সমাজের সর্বস্তরে  ঘিরে রয়েছে অন্ধকারের ঘন আস্তরণ। আলোর পথে চলার আন্তরিক আবেদন নিয়ে তাই প্রভাতসঙ্গীতের ভাবসমুদ্রে যাত্রা শুরু। আমরা দেখব, মহামূল্য রত্নসম্ভার বুকে নিয়ে সেই গানের তরী ভেসে চলেছে সুদূর আনন্দলোকে। চলার পথে সে সমস্ত মানুষের আশা-আকাঙ্খা, ভাব-ভাবনা কুড়িয়ে নিয়েছে। ব্যথা-বেদনা, অভাব-অভিযোগ বুঝে নিয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য-সুধা, বিশ্বেশ্বরের কৃপা-করুণা বিতরণ করেছে প্রাণে প্রাণে। কর্ম-জ্ঞান-ভক্তির তত্ত্ব-কথায়, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার ঝর্ণাধারায় সে এগিয়ে চলেছে--এগিয়ে চলেছে অবিরাম। অবাধ গতিতে। সবার আবেগ-আকুতি-মর্মকথা অন্তরে মেখে সবাইকে ভূমার গান শোণাতে শোণাতে সে এগিয়ে চলেছে  পরম লক্ষ্যে। এক এক করে সেই তরী সমৃদ্ধ হয়েছে ৫০১৮টি সঙ্গীতে। উন্মোচিত হয়েছে এক নব দিগন্ত--সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য ইতিহাস।
শুধু প্রথম গানটিতেই নয় এই আকুতি প্রভাতসঙ্গীতের অজস্র গানে শোণা যায়। যেমন,


আঁধার থেকে আলোর পথে নিয়ে চলো মোরে অনুপম
বলিনি কিছু দাও আমারে হয়ো তুমি নিকটতম। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--৪৯১৪)


মনের আঁধার দূর করে দাও ঘন তমসায় নিশানা দেখাও
অগতির গতি হে বিশ্বপতি আমার শকতি তুমি জান
আলো জ্বালো জ্যোতি আনো।                       (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--২১৮৫)


মনের প্রদীপ নিবিয়া গিয়াছে তুমি এসো দীপশলাকা নিয়ে
হিয়ার কুসুম ঝরিয়া গেছে নোতুন কুসুম দাও ফোটায়ে। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--৯৩৪)


আলোর দেবতা শোণ মোর কথা আলো ঢালো আঁধার এ ভুবনে
স্পর্শ যাচে মন শিখি নাচে আনন্দ ভর জীবনে।          (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--৩৬৪৬)


                                                                                   (ক্রমশঃ)