প্রভাতসঙ্গীত আলোর সঙ্গীত
কথা হচ্ছিল প্রভাতসঙ্গীতের ভাবভূমিতে আলোর ঔজ্জ্বল্য নিয়ে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় প্রভাতসঙ্গীত আলোর সঙ্গীত, প্রভাতসঙ্গীত জ্যোতির্গীতি। প্রভাতসঙ্গীত আলো-নির্ঝর। অজস্র ধারায় উত্সৃত, অজস্র ভাবে অভিদীপ্ত প্রভাতসঙ্গীত জ্যোতির্লোকে উত্তরণের স্বর্ণসোপান। ৫০১৮টি প্রভাতসঙ্গীতের মধ্যে বেশ কয়েকশ' গানে আমরা আলোর উল্লেখ পাই।
প্রসঙ্গক্রমে প্রভাতসঙ্গীতের নামকরণের সার্থকতা সম্পর্কে দু’এক কথা বলা দরকার। অনেকেরই ধারণা প্রভাতসঙ্গীত বুঝি প্রভাতবেলায় গাওয়ার সঙ্গীত বা প্রভাতকালিক সঙ্গীত। না, তা নয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রভাতসঙ্গীতের স্রষ্টা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের নামানুসারে সঙ্গীতসম্ভার ‘প্রভাতসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। তবে এটাই শেষ কথা নয়। ‘প্রভাতসঙ্গীত’ নামকরণের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লুকিয়ে আছে সঙ্গীতাবলীর ভাবসমুদ্রের অতল তলে--নান্দনিক রসমাধুর্যের অভিদ্যোতনায়।
সমাজ আজ শোষণে-শীর্ণ, দ্বন্দ্বে দীর্ণ। অত্যাচার, অনাচার, অবহেলায় সমাজ আজ পর্যূদস্ত। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে বিজ্ঞান ও প্রৌদ্যোগিক ক্ষেত্রে আজ আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। কিন্তু সেই সঙ্গে অন্তর্জগতের উন্নতি হয়েছে কোথায়!
আজও আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থা গড়তে পারলাম না যেখানে সব মানুষ এক সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবে। সমাজ মানেই তো একসঙ্গে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া। যে পিছিয়ে পড়েছে তার হাত ধরে তুলে নেওয়া। মানবতা আজ ভূলুন্ঠিত। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের আজ পেটে অন্ন নেই, মাথায় ছাদ নেই। অর্ধাহারে, অনাহারে, অবহেলায়, কোনরকম ভাবে বেঁচে আছে তারা। তার ওপর হিংসার অনল শিখায় জ্বলেছে সবার দেহ-মন। সর্ববগ্রাসী বিধ্বংসী যুদ্ধের আতঙ্কতো আছেই। এই তমসাচ্ছন্ন দিনের কথা উপলব্ধি করতে পেরেই বোধ হয় প্রভাতরঞ্জন এক আলো-ঝরা সোণালী স্বপ্নের দেশ কল্পনা করেছেন। সবার অন্তর-বাহিরে আলোর প্রদীপ জ্বালতে চেয়েছেন। যে সঙ্গীত সমস্ত অন্ধকার দূরে সরিয়ে মানবজীবনে আলো-ঝরা প্রভাতের শুভ সূচনা করে তা-ই প্রভাতসঙ্গীত। প্রভাতঙ্গীত নবজাগরণের সঙ্গীত--বিবেকের উদ্বোধনী সঙ্গীত। প্রভাতসঙ্গীত আলোর সঙ্গীত। প্রভাতঙ্গীত তাই বলে,
বাঁধ ভেঙেছে আলোকের আজ আকাশ বাতাস রাঙা হলো
বদ্ধ ঘরে দ্যুতি এলো কোথা হতে কে জানে বলো।
গান ছুটেছে বন্ধন ভেঙে সেই আলোকে রঙে রঙে
জানে না সে কাহার সঙ্গে আজকে মনের মিল হলো।
আঁধারে কাঁদিতে ছিলো এই বসুধা আলোর ঝর্ণা ঢেলে দিলে
অনু পরমাণুতে ভরালে সুধা মুক্তির সঙ্গীত শোণালে। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--৪৯৬২)
আলোকচ্ছ্বল ধরীত্রিতল, এ আলো জ্বালালো বলো কে
মনের গভীরে স্তরে বিস্তরে রাঙিয়ে দিলে সবাকে।
অন্ধ তমিস্রা পার হতে আলোর প্রতীতি আনিলে জগতে
মন্ত্রমুগ্ধ ব্যস্ত চকিত করে দিলে নীহারিকাকে। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--৩৫৩২)
আলোর দেবতা এসেছে তমসার মসী সরেছে
আকাশে বাতাসে মধু বারতা নিমেষে ছড়িয়ে পড়েছে।
যে আঁধার ছিলো সূচীভেদ্য উৎক্রমণ ছিলো অসাধ্য
ক্ষণিকে তা হলো বাধ্য রাত্রির তপস্যা ফলে ভরেছে। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা--1177)
প্রভাতসঙ্গীত শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত নব প্রভাতের বার্তাবহ সঙ্গীত। প্রভাতসঙ্গীত জেগে ওঠার মন্ত্রসঙ্গীত। তাই এ প্রভাতসঙ্গীত। এই বর্ণালী আনন্দোচ্ছ্বল আলোর মহোত্সবে সকলকে প্রভাতসঙ্গীত আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেঃ
আলোকের উৎসবে এসো সবে,
আলোকের উৎসবে এসো সবে
প্রজ্ঞা জ্যোতিতে জাগাই জগতে
মিলে মিশে কাজ করে এ মহাহবে।
কেহ কখনো কাহারও পর নয়
বোধের অভাবে নিকটও দূর হয়
মানুষ জেনে যাক কী তার পরিচয়
তারই আয়োজন করি এ উৎসবে।
পিছনে থাকিব না অতীতে তাকাবো না
কাকেও পিছিয়ে থাকিতে দোব না
সবারে সাথে নিয়ে মোদের এ সাধনা
এ আলো পুঞ্জীভূত গ্লানি নাশিবে।
আলোকের এ উৎসবে এসো সবে এসো সবে।
সঙ্গীত জিনিষটা তত্ত্বগতভাবে যতই আলোচনা করা হোক না কেন তার প্রকৃত রস আস্বাদন করতে গেলে তাকে শুণতে হবে। এই কথা ভেবে এবার থেকে প্রভাতসঙ্গীতের কিছু লিঙ্ক প্রতিদিন যুক্ত করার কথা ভাবছি। আজকের লিঙ্কে দুটি গান প্রখ্যাত গায়কী সুস্মিতা গোস্বামীর টিভিতে গাওয়া দুটি প্রভাতসঙ্গীত।
https://www.youtube.com/watch?v=lItvp9imaiE&index=6&list=RDlItvp9imaiE
(ক্রমশঃ)